Sunday, November 18, 2012

মুহাররম ও আশুরা


إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْراً فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ مِنْهَآ أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ. التوبة:36

"নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি, আসমাসমূহ ও পৃথিনী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মনিত।" (সূরা তাওবা: ৩৬)


এটা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ মাস। কুরআনের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’-অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম। এ মাসে রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

"أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ. حَدِيثٌ صَحِيحٌ/ أَخْرَجَهُ مُسْلِمٌ."

‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।’ – (সহীহ মুসলিম)

এর মধ্যে আশুরার রোযার ফযীলত আরও বেশি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন:

"رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَحَرَّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضَّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إِلَّا هَذَا الْيَوْمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَهَذَا الشَّهْرَ يَعْنِي شَهْرَ رَمَضَانَ." حَدِيثٌ صَحِيحٌ/ رواه البجاري.

‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ – (সহীহ বুখারী)

হযরত আলী (রা:) কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’- জামে তিরমিযী অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (সহীহ মুসলিম; জামে তিরমিযী) আশুরার রোযা সম্পর্কে এক হাদীসে আছে যে,

"صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَالِفُوا فِيهِ الْيَهُودَ، صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا، أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا."

‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’ (মুসনাদে আহমদ)

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোযা রাখব।’ – (সহীহ মুসলিম)

Thursday, November 15, 2012

সহীহ্ মুসলিম: ৮

উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসেছিলাম,
এমন সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের সামনে উপস্থিত হয়, যার কাপড় ছিল ধবধবে সাদা, চুল ছিল ভীষণ কালো; তার মাঝে ভ্রমণের কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। আমাদের মধ্যে কেউ তাকে চিনতে পারে নি।
সে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে গিয়ে বসে, নিজের হাঁটু তার হাঁটুর সঙ্গে মিলিয়ে নিজের হাত তার উরুতে রেখে বললেন:
“হে মুহাম্মাদ, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন”।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “ইসলাম হচ্ছে এই- তুমি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল, সালাত প্রতিষ্ঠা কর, যাকাত আদায় কর, রমাদানে সওম সাধনা কর এবং যদি সামর্থ থাকে তবে (আল্লাহর) ঘরের হজ্জ কর।”

তিনি (লোকটি) বললেন: “আপনি ঠিক বলেছেন”।

আমরা বিস্মিত হলাম, সে নিজে তার নিকট জিজ্ঞাসা করেছে আবার নিজেই তার জবাবকে ঠিক বলে ঘোষণা করছে।

এরপর বলল: “আচ্ছা, আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন”।

তিনি (রাসূল) বললেন: “তা হচ্ছে এই- আল্লাহ্, তাঁর ফিরিশ্‌তাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ ও আখেরাতর উপর ঈমান আনা এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর ঈমান আনা।”

সে (আগন্তুক) বলল: “আপনি ঠিক বলেছেন”।
তারপর বলল: “আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন”।

তিনি বলেন: “তা হচ্ছে এই- তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদাত কর যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ, আর তুমি যদি তাঁকে দেখতে নাও পাও তবে তিনি তোমাকে দেখছেন”।

সে (আগন্তুক) বলল: “আমাকে কেয়ামত সম্পর্কে বলুন”।

তিনি (রাসূল) বললেন: “যাকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে সে জিজ্ঞাসাকারী অপেক্ষা বেশী কিছু জানে না”।

সে (আগন্তুক) বলল: “আচ্ছা, তার লক্ষণ সম্পর্কে বলুন”।

তিনি (রাসূল) বললেন: “তা হচ্ছে এই- দাসী নিজের মালিককে জন্ম দেবে, সম্পদ ও বস্ত্রহীন রাখালগণ উঁচু উঁচু প্রাসাদে দম্ভ করবে”।

তারপর ঐ ব্যক্তি চলে যায়, আর আমি আরো কিছুক্ষণ বসে থাকি। তখন তিনি (রাসূল) আমাকে বললেন:
“হে উমার, প্রশ্নকারী কে ছিলেন, তুমি কি জান?

আমি বললাম: “আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল অধিক ভাল জানেন”।

তিনি বললেন: “তিনি হলেন জিবরীল। তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে তোমাদের কাছে এসেছিলেন।”

[সহীহ্ মুসলিম: ৮]

Sunday, November 11, 2012

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা

আলী ইবন আবী তালেব [রা]-কে জিজ্ঞেস করা হলো :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আপনাদের ভালোবাসা কেমন ছিল? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, তিনি আমাদের কাছে প্রিয়তর ছিলেন আমাদের সম্পদ, সন্তান ও পিতা-মাতা থেকে। তিনি আমাদের কাছে তীব্র পিপাসায় ঠান্ডা পানি চেয়েও বেশি প্রিয় ছিলেন।  [কাযী ‘ইয়াদ, আশ-শিফা : ৫৬৭/২]


তিন জন ব্যতীত আর কেউই দোলনায় কথা বলেননি

আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, (বানী ইসরাঈলের) তিন জন ব্যতীত আর কেউই দোলনায় কথা বলেননি।

(ক) ঈসা ইবনু মারিয়াম এবং
(খ) ছাহেবে জুরায়জ।

জুরায়জ একজন আবেদ বান্দা ছিলেন। নিজের জন্য একটি ইবাদতখানা তৈরী করে তিনি সেখানেই বসবাস করছিলেন। তার মা সেখানে আসলেন। তিনি এই সময় ছালাত পড়ছিলেন। তার মা বললেন, হে জুরায়জ! তখন তিনি (মনে মনে) বললেন, হে রব! আমার ছালাত ও আমার মা। জুরায়জ ছালাতেই মগ্ন থাকলেন। তার মা চলে গেলেন। তার মা পরের দিন আসলেন। তিনি এবারও ছালাতে রত ছিলেন। তাকে তার মা ডাকলেন, হে জুরায়জ! তিনি (মনে মনে) বললেন, হে রব! আমার মা ও আমার ছালাত। তিনি ছালাতেই মগ্ন থাকলেন। পরের দিন এসেও মা তাকে ছালাতে মগ্ন দেখলেন। তিনি ডাকলেন, হে জুরায়জ! জুরায়জ বলেন, হে আল্লাহ! আমার মা ও আমার ছালাত। তিনি তার ছালাতেই রত থাকলেন। তার মা বললেন, হে আল্লাহ! তুমি একে ব্যভিচারী নারীর চেহারা না দেখা পর্যন্ত মৃত্যু দিও না। বানী ইসরাঈলের মাঝে জুরায়জ ও তার ইবাদতের চর্চা হ’তে লাগল। এক যিনাকারী নারী ছিল। সে উলে¬খযোগ্য রূপ-সৌন্দর্যের অধিকারিণী ছিল। সে বলল, যদি তোমরা বল তবে তাকে (জুরায়জকে) আমি বিভ্রান্ত করতে পারি। সে তাকে বিরক্ত করতে লাগল, কিন্তু সেদিকে তিনি (জুরায়জ) লক্ষ্যই করলেন না। তারপর মহিলাটি তার ইবাদতখানার নিকটবর্তী এলাকায় এক রাখালের নিকট আসল। নিজের উপর তাকে সে অধিকার দিল এবং উভয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হ’ল। এতে করে সে গর্ভধারণ করল। সে সন্তান জন্ম দিয়ে বলল, এটা জুরায়জের সন্তান। বানী ইসরাঈলরা (রাগান্বিত হয়ে) জুরায়জের নিকট এসে তাকে ইবাদতখানা থেকে বাইরে নিয়ে আসল, ইবাদতখানাটি ধ্বংস করে দিল এবং তাকে মারধর করতে লাগল। জুরায়জ বললেন, তোমাদের কি হয়েছে? তারা বলল, এই নারীর সাথে তুমি ব্যভিচার করেছ। ফলে একটি শিশু জন্ম নিয়েছে। তিনি বললেন, শিশুটি কোথায়? তারা শিশুটিকে নিয়ে আসল। জুরায়জ বললেন, আমাকে একটু সুযোগ দাও, ছালাত পড়ে নেই। অতঃপর তিনি ছালাত পড়লেন। ছালাত শেষে তিনি শিশুটির নিকট এসে তার পেটে খোঁচা মেরে প্রশ্ন করলেন, হে শিশু! তোমার জন্মদাতা কে? সে বলল, অমুক রাখাল আমার পিতা। তখন উপস্থিত ব্যক্তিরা জুরাইজের দিকে আকৃষ্ট হ’ল এবং তাকে চুমু দিতে লাগল। তারা বলল, আমরা এখন তোমার ইবাদতখানাটি স্বর্ণ দিয়ে তৈরী করে দিচ্ছি। তিনি বললেন, প্রয়োজন নেই, বরং আগের মতো মাটি দিয়েই তৈরী করে দাও। তারপর তার ইবাদতখানাটি তারা আবার নির্মাণ করে দিল।

(গ) একটি বাচ্চা তার মায়ের দুধ পান করছিল। একটি লোক এমন সময় সেখান দিয়ে দ্রুতগামী ও উন্নত মানের একটি জন্তুযানে সওয়ার হয়ে যাচ্ছিল। তার পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল উন্নত মানের। শিশুটির মা বলল, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এই লোকের ন্যায় উপযুক্ত করো। দুধপান ছেড়ে দিয়ে শিশুটি লোকটির দিকে তাকাল, তারপর বলল, হে আল্লাহ আমাকে এই লোকের মতো করো না? এই বলে সে পুনরায় দুধ পান করতে থাকল। (বর্ণনাকারী বলেন), আমি যেন এখনও দেখছি, শিশুটির দুধ পানের চিত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তুলে ধরছেন এবং নিজের তর্জনী (শাহাদাৎ অঙ্গুলি) মুখে দিয়ে চুষছেন। তিনি (নবী) বললেন, একটি দাসীকে মারতে মারতে লোকেরা নিয়ে যাচ্ছিল আর বলছিল, তুমি ব্যভিচার করেছ এবং চুরি করেছ। মহিলাটি বলছিল, আমার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট এবং আমার জন্য তিনিই উত্তম অভিভাবক। শিশুটির মা বলল, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে তুমি এই ব্যভিচারিণী মহিলার মতো করো না, দুধপান ছেড়ে দিয়ে শিশুটি মহিলাটির দিকে দৃষ্টিপাত করল, তারপর বলল, হে আল্লাহ! আমাকে তুমি এই মহিলার মতো করে গড়ে তুলো। মা ও শিশুর মাঝে এ সময় কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেলো। মা বলল, একজন সুঠাম ও সুন্দর লোক চলে যাবার সময় আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে এমন উপযুক্ত করে দাও। তখন তুমি বললে, হে আল্লাহ! আমাকে এরকম করো না। আবার এই দাসীকে লোকেরা যখন মারধর করতে করতে নিয়ে যাচ্ছে এবং বলছে, তুমি ব্যভিচার করেছ এবং চুরি করেছ। আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এর মতো করো না। আর তুমি প্রতিউত্তরে বললে, হে আল্লাহ! আমাকে এমন করো। শিশুটি এবার উত্তর দিল, প্রথম লোকটি ছিল স্বৈরাচারী অত্যাচারী। আমি সেজন্যই বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে এই লোকের মতো করো না। আর এই নারীকে তারা বলে, তুমি যিনা করেছ। সে প্রকৃতপক্ষে যিনা করেনি। তারা বলে, তুমি চুরি করেছ, প্রকৃতপক্ষে সে চুরি করেনি। এ কারণেই আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে এ মহিলাটির মতো করো।

(বুখারী হা/৩৪৩৬; মুসলিম হা/২৫৫০)

আয়াতুল কুরসী

আবূ হুরাইরা হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন: “একদা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আমাকে রমযানের যাকাতের হেফাযতে নিযুক্ত করেন। রাতে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি আসে এবং হাত ভরে ভরে যাকাতের খাদ্য দ্রব্য চুরি করে। আমি তাকে গ্রেফতার করি এবং বলি: আল্লাহর কসম! তোমাকে রসুলুল্লাহর (সাঃ) নিকট পেশ করবো। সে বলে: আমি দরিদ্র আমার সন্তান-সন্ততি আছে। আমি খুব অভাবী। দুঃখ্ শুনে আমি তাকে ছেড়ে দেই। সকাল হলে নবী (সাঃ) আমাকে বলেন: আবু হুরাইরা! গত রাতে তোমার বন্দী কি করেছিল? আমি উত্তরে বলি: আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সে আমার কাছে দুঃখ-দুস্থতার কথা বলে, ছেলে পেলের কথা বলে। আমার মায়া চলে আসে, আমি তাকে ছেড়ে দেই। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন সে মিথ্যা বলেছে এবং সে আবার আসবে। আমার বিশ্বাস হয়ে যায় সে অবশ্যই আসবে কারণ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) পুনরায় আসার কথা বললেন। আমি তাক লাগিয়ে থাকি। রাতে আবার হাত ভরে ভরে যাকাতের খাদ্য চুরি করে। আমি তাকে গ্রেফতার করে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) -র দরবারে পেশ করতে চাইলে, সে বলে: ছেড়ে দাও ভাই! আমি দুঃখি মানুষ, বাড়িতে আমার সন্তান-সন্ততি আছে, আমি আর আসব না। কথা শুনে তার প্রতি আমার রহম হ
য়। আমি ছেড়ে দেই। সকালে আল্লাহর রাসূল বলেন: আবূ হুরাইরাহ তোমার কয়দীর খবর কি? আমি উত্তরে বলি: আল্লাহর রাসূল সে তার দুঃখের কথা বলে, ছোট ছোট বাচ্চার কথা বলে, শুনে আমার রহম চলে আসে আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। রাসূল (সাঃ) বলেন: সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে এবং সে আবার আসবে। আমি তৃতীয়বার তার অপেক্ষায় থাকি। আবার চুরি। পাকড়ও করে বলি, এবার অবশ্যই রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট পেশ করব। এটা শেষ তৃতীয়বার। তুমি বলো: আর আসবে না, আবার আস। সে বলে আমাকে ছেড়ে দাও। বিনিময়ে তোমাকে কিছু বাক্য শিক্ষা দেব। আল্লাহ তা দ্বারা তোমার উপকার করবে। আমি বলি সেগুলি কি? সে বলে: যখন তুমি বিছানায় শুতে যাবে তখন আয়াতুল কুরসী পড়বে। (আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যূল কাইয়্যূম) শেষ আয়াত পর্যন্ত। এ রকম করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বক্ষণের জন্য এক রক্ষক নির্ধারণ করা হবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার নিকটে আসবে না। এর পর আমি তাকে ছেড়ে দেই। সকালে আল্লাহ্‌র রাসূল আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেন: গত রাতে তোমার বন্দী কি করেছে? আমি বলি: সে আমাকে এমন কিছু কথা শিক্ষা দিতে চায় যার দ্বারা আল্লাহু আমার উপকার করবে। আমি তাকে ছেড়ে দেই। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন: সেই কথাগুলি কি? আমি বলি: সে আমাকে বলে: ঘুমানোর উদ্দেশ্যে যখন বিছানায় যাবে তখন আয়াতুল কুরসী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়বে (আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহ হুআল হাইয়্যূল কাইয়্যূম) সে বলে: এরকম করলে, তোমার হেফাযতের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বক্ষণের জন্য এক রক্ষক নির্ধারণ করা হবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার নিকটবর্তি হবে না। -বর্ণনাকারী বলেন: সাহাবায়ে কিরাম কল্যাণের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন- সবকিছু শুনার পর নবী (সাঃ) বলেন: সে আসলে মিথ্যুক কিন্তু তোমাকে সত্য বলেছে। আবুহুরায়রা ! তুমি কি জান, তিন দিন ধরে তুমি কার সাথে কথোপকথন করছিলে? সে বলে: না। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন: ও ছিল শয়তান। [সহীহ বুখারী নং ২৩১১]

Wednesday, November 7, 2012

মুমিনদের শাফা‘আত

ক্বিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর বিচারের পরে যারা সৎকর্মশীল তারা জান্নাতে চলে যাবে। আর মুমিনরা অন্য মুমিনদের জন্য আল্লাহর কাছে সুফারিশ করবে। ফলে বহু মানুষ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। এ সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছটি।আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,একদা কতিপয় লোক জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ক্বিয়ামতের দিন কি আমরা আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরের আকাশে সূর্য দেখতে কি তোমাদের কষ্ট হয় এবং মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে কি তোমাদের কোন অসুবিধা হয়? তারা বলল না, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এ সময় চন্দ্র-সূর্য দেখতে তোমাদের যে অসুবিধা হয় ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহকে দেখতে এর চেয়ে বেশী কোন অসুবিধা হবে না।

যখন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, তখন একজন ঘোষক ঘোষণা দিবেন, প্রত্যেক উম্মত যে যার ইবাদত করত সে যেন তার অনুসরণ করে। তখন যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করত, তাদের একজনও বাকী থাকবে না। সকলেই জাহান্নামের মধ্যে গিয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত এক আল্লাহর ইবাদতকারী নেককার ও গুনাহগার ছাড়া আর কেউ বাকী থাকবে না। তারপর আল্লাহ তাদের নিকট আসবেন এবং বলবেন, তোমরা কার অপেক্ষায় আছ? প্রত্যেক উম্মত, যে যার ইবাদত করত, সে তার অনুসরণ কর। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তো সে সব লোকদেরকে দুনিয়াতেই বর্জন করেছিলাম, যখন আজকের অপেক্ষায় তাদের কাছে আমাদের বেশী প্রয়োজন ছিল। আমরা কখনও তাদের সঙ্গে চলিনি। আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর বর্ণনায় আছে, তখন তারা বলবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের রব আমাদের নিকট না আসেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এ স্থানে অপেক্ষা করব। যখন আমাদের প্রতিপালক আসবেন, তখন আমরা তাকে চিনতে পারব।

আর আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় আছে, আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তোমাদের এবং তোমাদের প্রতিপালকের মধ্যে এমন কোন চিহ্ন আছে কি যাতে তোমরা তাঁকে চিনতে পারবে? তারা বলবে, হ্যাঁ। তখন আল্লাহর পায়ের নলা প্রকাশ করা হবে এবং বিশেষ আলো প্রকাশিত হবে। তখন যে ব্যক্তি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহকে সিজদা করত, শুধু তাকেই আল্লাহ সিজদার অনুমতি দিবেন। আর যারা কারো ভয়ে কিংবা মানুষকে দেখানোর জন্য সিজদা করত, তারা থেকে যাবে। তারা পিঠের পিছনের দিকে চিৎ হয়ে উল্টে পড়ে যাবে।

তারপর জাহান্নামের উপর দিয়ে পুলছিরাত পাতানো হবে এবং শাফা‘আতের অনুমতি দেওয়া হবে। তখন নবী রাসূলগণ স্ব স্ব উম্মতের জন্য এ প্রার্থনা করবেন, হে আল্লাহ! নিরাপদে রাখ, নিরাপদে রাখ। অনেক মুমিন এ পুলছিরাতের উপর দিয়ে চোখের পলকে পার হয়ে যাবে। অনেকেই বিদ্যুতের গতিতে পার হবে। অনেকেই বাতাসের গতিতে পার হবে। অনেকেই ঘোড়ার গতিতে পার হবে। আবার অনেকেই উটের গতিতে পার হবে। কেউ ছহীহ-সালামতে বেঁচে যাবে। আবার কেউ এমনভাবে পার হয়ে আসবে যে তার দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাবে। আবার কেউ খন্ড-বিখন্ড হয়ে জাহান্নামে পড়বে। অবশেষে মুমিনগণ জাহান্নাম হ’তে নিষ্কৃতি লাভ করবে। তারপর নবী করীম (ছাঃ) কসম করে বললেন,

তোমাদের যে কেউ নিজের হক বা অধিকারের দাবীতে কত কঠোর তা তো তোমাদের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু মুমিনগণ তাদের সে সমস্ত ভাইদের মুক্তির জন্য আল্লাহর সাথে আরও অধিক ঝগড়া করবে, যারা তখনও জাহান্নামে পড়ে রয়েছে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! এ সমস্ত লোকেরা আমাদের সাথে ছিয়াম পালন করত, ছালাত আদায় করত এবং হজ্জ পালন করত। সুতরাং তুমি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ দাও।

তখন আল্লাহ বলবেন, যাও তোমরা যাদেরকে চিন তাদেরকে জাহান্নাম হ’তে মুক্ত করে আন। তাদের মুখের আকৃতি জাহান্নামের আগুনের প্রতি হারাম করা হয়েছে। এজন্য তারা মুখ দেখে চিনতে পারবে। তখন তারা জাহান্নাম হ’তে অনেক লোক বের করে আনবে।

তারপর বলবেন, হে আমাদের প্রতিপালক! এখন সেখানে আর এমন একজন লোকও নেই যাকে বের করার জন্য আপনি আদেশ করেছেন।

তখন আল্লাহ বলবেন, আবার যাও যাদের অন্তরে এক দীনার পরিমাণ ঈমান আছে তাদেরকে বের করে আন। এতেও তারা বহু সংখ্যক লোককে বের করে আনবে। তারপর আল্লাহ বলবেন, পুনরায় যাও যাদের অন্তরে অর্ধ দীনার পরিমাণ ঈমান আছে তাদেরকে বের করে আন। সুতরাং তাতেও তারা বহু সংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবে।

তারপর আল্লাহ বলবেন, আবার যাও যাদের অন্তরে এক বিন্দু পরিমাণ ঈমান আছে, তাদেরকে বের করে আন। এবারও তারা বহুসংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবে এবং বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! ঈমানদার কোন ব্যক্তিকে আমরা জাহান্নামে রেখে আসিনি।

তখন আল্লাহ বলবেন, ফেরেশতাগণ, নবীগণ এবং মুমিনগণ সকলেই শাফা‘আত করেছেন। এখন আমি পরম দয়ালু ব্যতীত আর কেউ বাকী নেই। এ বলে তিনি মুষ্টি ভরে এমন একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করবেন যারা কখনও কোন নেক কাজ করেনি, যারা জ্বলে-পুড়ে কালো কয়লা হয়ে গেছে। অতঃপর তাদেরকে জান্নাতের সামনে একটি নহরে ঢেলে দেওয়া হবে, যার নাম হ’ল ‘নহরে হায়াত’।

এতে তারা স্রোতের ধারে যেমনভাবে গাছের বীজ গজায়, তেমনিভাবে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সজীব হয়ে উঠবে। তখন তারা সেখান থেকে বের হয়ে আসবে মুক্তার মত চকচকে হয়ে। তাদের কাঁধে সীল মোহর থাকবে। জান্নাতীরা তাদের দেখে বলবে এরা পরম দয়ালু আল্লাহর মুক্তকৃত দাস। আল্লাহ্ তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন, অথচ তারা পূর্বে কোন আমল বা কোন কল্যাণের কাজ করেনি। অতঃপর তাদেরকে বলা হবে, এ জান্নাতে তোমরা যা দেখছ, তা তোমাদেরকে দেওয়া হ’ল এর সঙ্গে অনুরূপ পরিমাণ আরও দেওয়া হ’ল’

দুনিয়াতে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করলে কিংবা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করলে পরকালে ঐ উপাস্য-মা‘বূদ ও শরীকদের সাথেই জাহান্নামে যেতে হবে। পক্ষান্তরে যারা কেবল আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখত, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করতো না; তারা কোন নেকীর কাজ না করলেও এক সময় জান্নাতে যাবে তাদের ঈমানের কারণে। তাই আল্লাহর প্রতি খালেছ অন্তরে ঈমান আনতে হবে। তাহ’লে জান্নাত লাভ করা যাবে। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রতি একনিষ্ঠভাবে ঈমান আনার তাওফীক্ব দিন- আমীন!

(Courtesy: QuranerAlo.com)